ডায়াবেটিস কমানোর উপায় গুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরবো ডায়াবেটিস কমানোর উপায় সম্পর্কে। বর্তমানে ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ হয়ে উঠেছে। অসতর্কতার কারণে ডায়াবেটিস মারাত্নক একটি রোগে পরিণত হতে পারে। তাই এই রোগের প্রতিরোধ করতে হলে বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমাদের জানা উচিৎ এবং ডায়াবেটিস কমানোর উপায় গুলো সম্পর্কে জানা উচিৎ। চলুন তাহলে জেনে নেই ডায়াবেটিস কমানোর উপায় গুলো সম্পর্কে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করনীয়
ডায়াবেটিস রোগের প্রতিরোধ বলতে সুস্পষ্টভাবে তিন ধরনের বা তিনটি ধাপে প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়ছে। প্রথমত হচ্ছে প্রাথমিক প্রতিরোধ বা প্রাইমারি প্রিভেনশন। অর্থাৎ রোগ হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করা। এজন্য চাই সামাজিক সচেতনতা। ছোটবেলা থেকেই সবুজ শাকসবজি, মাছ ও কম চর্বি শর্করাযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। বেশি বেশি ক্যালরি যুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান।
রোগের লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে অবগতি, রক্তের চিনি পরীক্ষা করা জরুরি, শনাক্তকরণ পরীক্ষার সহজলভ্যতা ও ব্যয় সংকোচন। এই বিষয়গুলো সেকেন্ডারি প্রিভেনশনের আওতায় পড়ে। চল্লিশ বা এর বেশি বয়স হলে অন্তত তিন বছর পরপর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। স্থূলতা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি কারণে ঝুঁকি থেকে থাকলে বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। গর্ভবতী হওয়ার পর অবশ্যই প্রতিবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করলে অনেক জটিলতাই এড়ানো সম্ভব।
তৃতীয় ধাপে আছে যাদের ইতিমধ্যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া, এবং আরও জটিলতা এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। কেননা ডায়াবেটিস নীরবে রোগীর চোখ, রক্তনালি, হার্ট, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদির ভয়ানক ক্ষতি করে। জটিল রোগীদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ও পুনর্বাসন করাও ডায়াবেটিস চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।
ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা কিনা স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তবে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম অথবা ব্যায়াম কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে। যে কয়টি অসুখ মানুষের দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তীর সৃষ্টি করে তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে
গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে ডায়াবেটিস এর উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ইনসুলিনের অভাব হলে শরীরে শর্করা, আমিষ এবং চর্বিজাতীয় খাবারের বিপাক যথাযথভাবে সংঘটিত হতে পারে না। এতে শরীরে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের স্বাভাবিক সমতাও নষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি তন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কিডনী, হ্নৎপিন্ড, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যহত করে ফেলে। ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় একইসাথে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আবার কখনও স্ট্রোক, অন্ধত্ব অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যুর মত মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে।
সংক্রামক রোগের মত ডায়াবেটিসের সুনিদিষ্ট কোন কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বংশগতি বা পারিবারিক প্রবণতা, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, মুটিয়ে যাওয়া, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, কম শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি সার্বিক জীবন-যাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর নিবীড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। উল্লিখিত বিষয়গুলো ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি অনেক খানি বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে ওজন বেড়ে যাওয়াকে ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তাই জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের একটি পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চিকিৎসার পাশাপাশি এর প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকমাত্রায় ক্লান্তি বোধ করা ডায়বেটিসের সাধারণ উপসর্গ। কখনও কখনও ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও এসব উপসর্গ অনুপস্থিত থাকতে পারে। কারও ডায়বেটিসের লক্ষণ থাকলে কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারও ডায়াবেটিস থাকলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ মত ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করতে হবে। এতে আগেভাগে ডায়াবেটিস নির্ণয় করে এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের মারাত্মক সব জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে।
ডায়াবেটিসের কারণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও প্রতিরোধ করার জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কার্যকর স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম অথবা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর ২৮শে ফেব্রুয়ারি “জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য
হচ্ছে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করে এর প্রতিরোধ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন করা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে এবং ডায়াবেটিসের জটিলতামুক্ত সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে নিচের টিপসগুলো মেনে চলা প্রয়োজন।
● আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ম করে পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করুন।
● অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব পরিহার করুন। প্রতিদিন কিছু পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খান।
● ফাস্ট-ফুড এবং কোল্ড-ড্রিংক্স পরিহার করুন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
● বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পরিবেশিত রিচ ফুড যতটা সম্ভব পরিহার করুন অথবা এড়িয়ে চলুন।
● ওজন নিয়ন্ত্রণের চমৎকার একটি উপায় হচ্ছে হাঁটা। তাই কম দূরত্বের জায়গাগুলোতে হেঁটে চলাচল করুন।
● লিফ্ট-এর বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
● একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পাঁয়চারি করুন।
● অলসতা দূর করতে সংসারের টুকিটাকি কাজ নিজেই করুন। সুযোগ থাকলে বাগান করুন, খেলাধুলা করুন। সাঁতার কাটুন।
● কোমড়ে চওড়া বেল্ট ব্যবহার করতে পারেন। এতে মেদ দ্রুত বাড়তে পারবে না।
● প্রচলিত বিজ্ঞাপনের চমকে আকৃষ্ট হয়ে দ্রুত চিকন হওয়ার ওষুধ বা যন্ত্র ব্যবহার করতে যাবেন না। এতে আপনার অমঙ্গলের আশংকাই বেশী।
● প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতে আপনার মুটিয়ে যাওয়ার মাত্রা নির্ণয় করে বয়সানুসারে সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরী করুন।
● ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমত চিকিৎসা গ্রহণ করুন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন সংক্রান্ত তার সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা (যা শুধুমাত্র আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মেথি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক পথ্য। মেথিকে মসলা, খাবার ও পথ্য তিনটিই বলা চলে। মেথি স্বাদে তিতা হলেও এতে রয়েছে রক্তে সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণের বিস্ময়কর শক্তি। এছাড়া সকালে খালি পেটে এক চামচ পরিমাণ চিনি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস সমমান পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানি সকালে খালি পেটে পান করলে শরীরের রোগ জীবাণু মরে যায়, এবং একইসাথে, রক্তে শর্করার মাত্রা কমে, রক্তের ক্ষতিকর চর্বির (কোলেস্টেরল) মাত্রা কমে, শরীরে কৃমি থাকলে মারা যায়, গরম জনিত ত্বকের অসুখাদি দূর হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সকালে মেথি খান তাদের ডায়াবেটিস জনিত অন্যান্য অসুখ কম হয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মেথি হলো শ্রেষ্ঠ পথ্য তবে তার সঙ্গে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ট্যাবলেট বা ইনসুলিন সঠিকভাবে ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে।
যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের জন্যও মেথি উপকারী, যেমন মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, শরীরকে সতেজ রাখার জন্য, রক্তের উপাদানগুলোকে বেশি মাত্রায় কর্মক্ষম করার জন্য মেথি অত্যন্ত উপকারী। বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মেথি। নানাবিধ গুণসম্পন্ন এই মেথি আজ থেকেই হোক আমাদের সবার গুরুত্বপূর্ণ খাবার।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস এর লক্ষণ গুলো কি কি
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস কত পয়েন্ট হলে নরমাল?
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ২০২২
আমাদের শেষকথা
আজকের এই ব্লগ পোস্ট এর মাধ্যমে ডায়াবেটিস কমানোর উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। এই নিয়ম অনুসারে জীবনযাপন করলে আমরা অনেকখানি নিস্তার পাবো এই বিপাকজনিত রোগের হাত থেকে।
আমাদের এই ব্লগের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত স্বাস্থ্য টিপস, ভ্রমণ, টেকনোলজি, কম্পিউটার, মোবাইল, রিভিউ ইত্যাদি সম্পর্কে নিয়মিত আর্টিকেল পাবলিশ করে যাচ্ছি এবং আমাদের এই ধারা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশাবাদী। আশা করি এই ব্লগটি আপনারা পছন্দ করবেন।