সাজেক ভ্যালি (Sajek Valley)
সাজেক ভ্যালি ( Sajek Valley ) বর্তমান সময়ে ভ্রমণ প্রিয় মানুষদের সবচেয়ে পছন্দের যায়গা সাজেক। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক ভ্যালি। সাজেক বাংলাদেশের সবথেকে বড় ইউনিয়ন হিসেবে খ্যাত। আর আয়তন প্রায় ৭০২ বর্গমাইল জুড়ে। যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট।
কি কি দেখা যাবে সাজেক ভ্যালি থেকে
চারিদিকে মনোরম পরিবেশ আর সারি সারি পাহাড়, সাদা তুলোর মতো মেঘের ভ্যালি আপনাকে মুগ্ধ করবে। সাজেক এমন একটি আশ্চর্যজনক জায়গা যেখানে, একই দিনে আপনি প্রকৃতির তিন রকম রূপের দেখা পাবেন। কখনো প্রচণ্ড গরম কখনো বা হটাত বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারেন। আবার কখনো বা হঠাৎকরেই হারিয়ে যেতে পারেন ঘন কুয়াশার মাঝে।
প্রকৃতির মাঝে নিসর্গ আর তুলোর মতো মেঘের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় উড়ো-উড়ির খেলা দেখতে সাজেক সবচেয়ে আদর্শ ও সুন্দর জায়গা। সাজেকের কংলাক পাহাড় হলো সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। কংলাক পাড়া থেকেই কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেক ভ্যালির একদম শেষের গ্রামের নাম কংলাক পাড়া। যেখানে লুসাই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
সাজেক থেকে দুই ঘণ্টা ব্রে-কিং করে কমলক ঝর্ণা দেখে আশা যাবে। সুন্দর এই ঝর্ণাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈসা বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামেও সুপরিচিত। দিন অথবা রাত সাজেক যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। সময় গড়ায় তবুও সাজেক যেন পুরনো হয় না।
সাজেক ঘুরতে গেলে সকালের সময় টা একদমই মিস করা যাবে না। সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে হ্যালিপ্যাডে। সূর্যোদয়ের সময় মেঘেদের খেলা সূর্যোদয়ের আলো আপনাকে বিমোহিত করে তুলবে। সূর্যোদয়ের এই সৌন্দর্য দেখার জন্য আপনাকে খুব ভোরেই রওনা দিতে হবে হ্যালিপ্যাডের উদ্দেশ্য নিয়ে।
সন্ধ্যার পর রাতের আকাশে শুরু হয় কোটি কোটি তারার মেলা। মনোমুগ্ধকর এই তারার মেলা নিমিষেই আপনার প্রাণ জুড়িয়ে দেবে। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে দেখা মিলতে পারে মিল্কিওয়ে ও ছায়াপথের। চারিপাশে সহজ সরল আদিবাসীদের জীবন যাপন ঘুরে দেখতে পারেন। এছাড়া আশে পাশের বিভিন্ন জায়গা গুলো ঘুরে দেখতে পারেন। এখানকার পরিবেশ আপনাকে কিছুটা হলেও মুগ্ধ করবে। সময় থাকলে, ফেরার পথে ঘুরে আসতে পারেন হাজাছড়া ঝর্ণা, দীঘিনালা ব্রিজ এবং দীঘিনালা বনবিহার।
সাজেক যাওয়ার সঠিক সময়
সাজেকের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। প্রায় সারা বছরই বর্ণীল সাজে সেজে থাকে ভ্রমণ পিপাসুদের সুপরিচিত জায়গা সাজেক। বছরের যে কোন সময় আপনি এখানে যেতে পারেন। তবে জুলাই থেকে নভেম্বর মাসের মাঝে মেঘেদের খেলা দেখা যায় অনেক বেশি। এই মেলা দেখতে ভিড় করায় হাজারো ভ্রমণ প্রিয় মানুষ।
সাজেক যাতায়াত ব্যবস্থা
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে সাজেক। অন্যদিকে দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। রাঙ্গামাটি থেকে নৌ-পথে কাপ্তাই হয়ে আসলে কিছুটা পথ হেটেই সাজেক এ পৌঁছানো যায়।
রাঙ্গামাটি জেলাতে সাজেকের অবস্থান হলেও খাগড়াছড়ি থেকে সহজেই সাজেক যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি শহর বা দীঘিনালা থেকে স্থানীয় গাড়ি যেমন জিপ গাড়ী, সি.এন.জি বা মোটরসাইকেল করে যাওয়া সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। এক্ষেত্রে পথে দেখা মিলবে ১০ বাঘাইহাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প। মূলত সেখান থেকেই ভ্রমণরত সদস্যের তথ্য হালনাগাদ করে সাজেক যাওয়ার মূল অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। একে আর্মি এসকর্ট ও বলা হয়ে থাকে।
আর্মি কর্তৃপক্ষ হতে গাড়িবহরের মাধ্যমে পর্যটকদের গাড়িগুলোকে নিরাপত্তার সাথে সাজে পৌঁছে দেওয়া হয়ে থাকে। দিনে দুটি নির্দিষ্ট সময়ে আর্মি ক্যাম্পের পক্ষ থেকে সাজেক যাওয়ার বৈধ অনুমতি দেওয়া হয়। পর্যটকদের সর্বাধিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
সাজেক যাওয়ার জিপগাড়ি গুলোকে স্থানীয়ভাবে চান্দের গাড়ী বলা হয়ে থাকে। সাজেক যাওয়ার পথে বাঘাই-হাটে হাজাছরা ঝর্ণা অবস্থান করে। প্রধান সড়ক থেকে সামান্য ট্র্যাকিং করে উপভোগ করা যাবে এই ঝর্ণার সৌন্দর্য।
সাজেকে থাকার জায়গা
সাজেকে থাকার জন্য অনেক রিসোর্ট ও কটেজ আছে। রিসোর্ট ও কটেজের অবস্থান এবং বিভিন্ন ইন্টেরিওর ডিজাইন এবং এদের পরিবেশ বিভিন্ন ধরনের রয়েছে। এ সকল ভেদে এদের ভাড়া ও ভিন্ন হয়ে থাকে।
এক রাতের জন্য এই রিসোর্ট ভেদে প্রায় ১৫০০ থেকে ১৫০০০ টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে। তবে ছুটির দিন অন্যান্য দিনের থেকে ভাড়া একটু বেশিই খরচ হয়। ভালো থাকার জায়গা পাওয়ার জন্য অবশ্যই মাস খানেক আগে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। নতুবা থাকার জন্য ভালো রুম পাওয়া যায় না।
কম খরচে থাকতে চাইলেও আশেপাশে অনেক রিসোর্ট ও কটেজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও কম খরচে থাকার জন্য আদিবাসী কটেজগুলো তে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে কম-খরচে থাকার জন্য অনেকগুলো নতুন নতুন কটেজ তৈরি হয়েছে। মোটামুটি প্রতিটি কটেজ থেকেই সাজেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
আরও পড়ুন: ব্রণ দূর করার উপায়
আরও পড়ুন: ঘরোয়া পদ্ধতিতে চুলের যত্ন
আরও পড়ুন: রাগ নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
আরও পড়ুন: মানসিক চাপ দূর করার উপায়
সাজেক রিসোর্ট ও কটেজ (Sajek Resort and Cottages)
সাজেকে থাকার জন্য অনেক রিসোর্ট এবং কটেজের ব্যবস্থা আছে। তবে এখানে একেকটা কটেজ বা রিসোর্ট এ থাকার জন্য একেক রকম খরচ হয়। নিচে কিছু রিসোর্ট ও কটেজের নাম, খরচ, যোগাযোগের ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য উল্লেখ করা হলো।
রিসোর্ট রুংরাং ( Resort RungRang ): সাজেকের সেরা রিসোর্ট গুলোর মধ্যে একটি রিসোর্ট হলো রুংরাং। এই রিসোর্ট থেকেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন সারি সারি পাহাড় এবং মেঘের উড়ো-উড়ি। নান্দনিক ডিজাইনে সাজান আছে এই রিসোর্ট।
ছুটির দিন ব্যতীত অন্যান্য দিনের জন্য ডাবল বেডরুম ভাড়া ২৮০০ টাকা এবং কাপল রুমের ভাড়া ২০০০ টাকা। ছুটির দিন গুলোতে পর্যটক বেশি হওয়ায় ভাড়া কিছু টাকা বাড়তি খরচ হয়। ছুটির দিনে ডাবল রুম ভাড়া ৩৫০০ টাকা এবং কাপল রুম ভাড়া ২৮০০ টাকা।
যোগাযোগ: ০১৮৮৪৭১০৭২৩, ০১৮৬৯৬৪৯৮১৭
সাজেক রিসোর্ট: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত রিসোর্ট এর নাম হলো সাজেক রিসোর্ট। এখানে এসি বিহিন রুমের ভাড়া ১০,০০০/= থেকে ১৫,০০০/= টাকা। খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেনাবাহিনী তে কর্মরত রয়েছেন অথবা প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এই রিসোর্ট এ ডিসকাউন্ট রয়েছে।
যোগাযোগ: ০১৮৫৯০২৫৬৯৪, ০১৮৪৭০৭০৩৯৫
মেঘপুঞ্জি রিসোর্টঃ এই রিসোর্ট থেকে অসাধারণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। এই রিসোর্ট এর খরচ অন্যান্য রিসোর্ট এর থেকে একটু কম। এই রিসোর্টে সিঙ্গেল বেড ২০০০ টাকা এবং ডাবল বেড ১৫০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন।
যোগাযোগঃ ০১৮৮৫৪২৪২৪২
লুসাই কটেজঃ লুসাই কটেজে আছে ডাবল বেড সহ খাবারের ব্যাবস্থা। সুন্দর ও মনোরম পরিবেশের সাথে ভালো ডেকোরেশন এবং সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায় এই কটেজ থেকে। এই কটেজের রুম ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার টাকা মাত্র
যোগাযোগঃ ০১৬৩৪১৯৮০০৫
আদিবাসী ঘরঃ আপনারা চাইলে রাত্রি যাপন করার জন্য আদিবাসীদের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবেন। এতে প্রতি ১ জনের জন্য ২০০ থেকে ৩০০ তাকা খরচ হতে পারে। তবে এই ঘরগুলো ফ্যামিলি বা কাপলদের জন্য উপযুক্ত না হলেও বন্ধু-বান্দবদের জন্য ঠিকঠাক বলা চলে।
উপরে রিসোর্ট ও কতেজগুলোর নিয়মিত ভাড়ার পরিমাণ উল্লেখে করা হয়েছে। ছুটিরদিনে ভাড়া একটু বেশিই থাকে। এছাড়া অনেকসময় পর্যটকদের আনাগনা কম থাকলে রিসোর্ট ও কটেজ গুলোতে অনেকতা ছাড় পাওয়া যায়।
সাজেক এ খাবারে ব্যবস্থা (Food arrangements at Sajek)
সব রিসোর্ট এ খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আগে থেকে বলে রাখতে হয়। আগেই যদি রিসোর্ট এ বলে রাখেন তাহলে আপনার পছন্দের খাবার তৈরি করে দেবে। সেক্ষেত্রে প্রতি বেলা জনপ্রতি ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
মেনুতে ভাত, আলুভর্তা, মুরগির গোসত ইত্যাদি থাকবে। আপনি চাইলে রাতে বার বি কিউ তৈরি করতে পারবেন। এছাড়া আদিবাসীদের ঘরেও খাওয়া যায়। তবে আপনাকে আগে থেকেই বলে রাখতে হবে যে, আপনি কি খাবেন।
সাজেকে খুব অল্প টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন ফল যেমন, আনারস, কলা, পেঁপে ইত্যাদি ফলগুলো পাওয়া যায়। এই ফলগুলো পাহাড়ি অঞ্চলের যার কারণে, এগুলোর স্বাদ একটু আলাদা। এ স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
সাজেক ভ্রমণ টিপস (Sajek travel tips)
১। সাজেকে অনেক যায়গায় বিদ্যুৎ নেই, তবে সোলারের ব্যবস্থা রয়েছে। তারপরেও সাথে পাওয়ার ব্যাংক রাখতে ভুলবেন না।
২। সাজেকে শুধুমাত্র রবি, এয়ারটেল ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়। অন্যান্য সিমের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না বললেই চলে। তবে রবির নেটওয়ার্ক সবথেকে ভালো পাওয়া যায়।
৩। সাজেকে গাইডের প্রয়োজন হয় না। সাজেকের পথ আঁকাবাঁকা এবং উঁচুনিচু তাই জীপের ছাদে না ওঠাই উত্তম।
৪। যাবার আগে থাকার জন্য রিসোর্ট বুক করে রাখুন।
৫। আদিবাসীরা অনেক সহজ সরল। তাদের সাথে ভদ্রতা বজায় রাখুন এবং তাদের কালচার কে সম্মান করুন। মনে রাখবেন কোনো আদিবাসীদের সাথে ছবি তলার আগে তাদের অনুমতি নিতে হবে।
আমাদের শেষকথা
সাজেক অত্যন্ত সুন্দর একটি জায়গা। সাজেক যাওয়ার সময় আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আর্মি ক্যাম্পে আপনার তথ্য হালনাগাদ করুন। ভ্রমণকালে আপনার জাতীয় পরিচয় পত্র অবশ্যই সাথে রাখবেন।
সাজেক যাওয়ার সময় ২-৩ দিন অবস্থান করলে গাড়ী বসিয়ে না রেখে শুধুমাত্র যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করুন। ফেরার পথে আপনি অসংখ্য গাড়ী পেয়ে যাবেন। এতে করে আপনাকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে না।